ভূমিকম্পের ধ্বংসস্তুপ থেকে

ভূমিকম্পের ধ্বংসস্তুপ থেকে

কর্মব্যস্ত জীবনে শহুরে বহুতল ভবনে বসে জীবন/জীবিকার কাজ করছিলাম। হটাৎ অনুভব করলাম চারপাশটা ঢেউয়ের মতো দুলছে। কয়েক সেকেন্ড শকিং মুড পার করে বুঝতে বাকি রইল না ভূমিকম্প শুরু হয়েছে। বিল্ডিং-এর সবাই হইহুল্লোড় আর চিৎকার দিতে লাগল। মাত্র ৩০ সেকেন্ডের মধ্যেই ভূমিকম্পের তীব্রতা বেড়ে গেল। করণীয় কী!! দ্রুতই অফিসরুমের এককোণে গিয়ে দাঁড়ালাম। 'ইন্না-লিল্লাহি ও ইন্না ইলাইহি রাজিউন, লা ইলাহা ইল্লা আন্তা সুবহানাকা ইন্নি কুনতু মিনাজ্জলিমিন' প্রভৃতি দোয়া পড়ে আল্লাহকে বারবার ডাকতে লাগলাম। এটা পরম সৌভাগ্য যে, যেকোনো বিপদে অটোমেটিকলি আল্লাহর নাম মুখে চলে আসে। আসলে এটা নিজের কোনো কৃতিত্ব নয়; বরং মহান রবের পক্ষ থেকে তার নগণ্য বান্দার প্রতি করুণা ছাড়া আর কিছুই নয়। সুবহানাল্লাহি বিহামদিহি, সুবহানাল্লাহিল আজিম ।

পাশের বিল্ডিংটা হটাৎ খুব আওয়াজ করে ধসে পড়ল। ইন্না-লিল্লাহ! চারদিকের পরিবেশ মনে হচ্ছে আউট অফ কন্ট্রোল। এখানে বলে রাখি, আমরা আসলে আজন্ম আউট অফ কন্ট্রোল পাওয়ার নিয়েই চলি। কিন্তু এই ন্যাচারাল বাস্তবতা সব সময় বুঝতে পারি না। এই বুঝতে না পারাটাই বনি আদম হিসেবে আমাদের সবচেয়ে বড় বোকামি ও সীমাবদ্ধতা। কম্পনের তীব্রতায় অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই অনুভব করলাম আমি আর আগের জায়গায় নেই। মনে হচ্ছে কয়েকতলা নিচে গিয়ে আঁচড়ে পরলাম। চারদিকটা অন্ধকার হয়ে গেল। পা ও ঘাড়ে পচণ্ড ব্যথা অনুভব হচ্ছে। মোবাইলটা প্যান্টের ডান পকেটে ছিল, ডান হাত দিয়ে বের করার চেষ্টা করলাম। কিন্তু হাতের শক্তিটা মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যে যেন হারিয়ে যেতে লাগল। বুজতে পারলাম, শারীরের হাত-পায়ের শক্তিও আমার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। আমি আমাকে হারাতে চলেছি। কম্পন এখন স্থির হয়েছে। আমিও স্থির হয়ে আছি। কোনো করণীয় ঠিক করতে পারলাম না। আসলে কিছুই করার নেই।

আলোহীন চারপাশে হটাৎ আমার ভাবনার জানালায় সবার আগে বাবা-মায়ের কথা মনে পড়ল। হায় আল্লাহ! তাঁরা এই মুহূর্তে কোথায় আছেন, কেমন আছেন। তাঁদের অবস্থা কি আমার মতো? আমার চেয়ে কিছুটা ভালো আছে কি? নাকি আমার চেয়েও খারাপ অবস্থায়? হায় আল্লাহ! তুমি মাপ করো!! একে একে পরিবার ও প্রিয় ভাই, প্রিয় মানুষগুলোকে মনে পড়ছে। হটাৎ পরিবর্তনীয় চারপাশটায় এখন কে কী অবস্থা আছে। ভাবতে ভাবতে দুচোখ ভেয়ে অশ্রু গড়াতে লাগল। এর মধ্যেই পানির প্রচণ্ড তৃষ্ণা অনুভূত হলো। কিন্তু আমার হাত-পা যেখানে অচল, চারপাশ অন্ধকার, সেখানে পানি কীভাবে পাব? এই ভাবনার মাঝেই যুক্ত হলো কুরআনে বর্ণিত ইউনুস (আ.)-এর মাছের পেটে অবস্থানের ঘটনাটি। তিনি যে দোয়াটি পড়েছিলেন, জিহ্বা দিয়ে সেটিই আওড়ানোর চেষ্টা করলাম। ভাবনার অস্থির দৌড়াদৌড়ি মাঝেই মনে হচ্ছিল আমি আস্তে আস্তে স্থির হচ্ছি এবং আসন্ন স্থায়ী সফরের চিত্র মনের দৃশ্যপটে সামনে আসতে লাগল। অনন্তকালীন সফর, যে সফর থেকে কেউ ফিরে আসে না।

(কোনো এক ভূমিকম্পের দিনে হয়তো এমনটাই ঘটবে)

আসলে ভূমিকম্প কেন হয়?

১.খুবই সাধারণ ও সিম্পল ব্যাখ্যা : পৃথিবীর ভূপৃষ্ঠ ৭টি বড় টেকটোনিক প্লেট ও অসংখ্য সাব-প্লেট বা ছোট ছোট প্লেট নিয়ে গঠিত। এই প্লেটগুলোর পরস্পর ধাক্কা বা ঘর্ষণের ফলেই ভুমিকম্পের সৃষ্টি হয়। (আস্তিক, নাস্তিক, আংশিক আস্তিক/আংশিক নাস্তিক সবাই এতে একমত)

২. পাপাচার বেড়ে গেলে এবং ওহী অস্বীকার করলে : জনপদে যখন অশ্লীলতা, অন্যায়, জুলুম ও পাপাচার অনেক বেশি বৃদ্ধি পায়। এ ছাড়াও আল্লাহর পক্ষ থেকে ওহীর প্রতিনিধি অর্থাৎ নবী-রাসূলদের যখন অস্বীকার করা হয়। সত্য অনুসারীদের দাওয়াত ও আদর্শকে অগ্রাহ্য করে যখন তাঁদের ওপর মিথ্যা আরোপ কিংবা জুলুম করা হয়। যেমন : মহান আল্লাহ বলেন-

فَكَذَّبُوْهُ فَاَخَذَتْهُمُ الرَّجْفَةُ فَاَصْبَحُوْا فِیْ دَارِهِمْ جٰثِمِیْنَ٘-

"কিন্তু তারা তাঁর (শু'আইব আ.) প্রতি মিথ্যা আরোপ করল। শেষে একটি প্রচণ্ড ভূমিকম্প তাদেরকে পাকড়াও করল এবং তারা নিজেদের ঘরের মধ্যে মরে পড়ে থাকল।" (সূরা আনকাবুত : ৩৭)

৩. অপরাধী সম্প্রদায়ের শাস্তির পাশাপাশি আল্লাহর পক্ষ থেকে বিশ্বাসীদের জন্য পরীক্ষা হিসেবে : মহান আল্লাহর বাণী-

فَلَمَّاۤ اَخَذَتْهُمُ الرَّجْفَةُ قَالَ رَبِّ لَوْ شِئْتَ اَهْلَكْتَهُمْ مِّنْ قَبْلُ وَ اِیَّایَ١ؕ اَتُهْلِكُنَا بِمَا فَعَلَ السُّفَهَآءُ مِنَّا١ۚ اِنْ هِیَ اِلَّا فِتْنَتُكَ١ؕ تُضِلُّ بِهَا مَنْ تَشَآءُ وَ تَهْدِیْ مَنْ تَشَآءُ١ؕ اَنْتَ وَلِیُّنَا فَاغْفِرْ لَنَا وَ ارْحَمْنَا وَ اَنْتَ خَیْرُ الْغٰفِرِیْنَ-

"যখন তারা একটি ভয়াবহ ভূমিকম্পে আক্রান্ত হলো, তখন মুসা বলল- “হে আল্লাহ! তুমি চাইলে আগেই এদেরকে ও আমাকে ধ্বংস করে দিতে পারতে। আমাদের মধ্য থেকে কিছু নির্বোধ লোক যে অপরাধ করেছিল, সেজন্য কি তুমি আমাদের সবাইকে ধ্বংস করে দেবে? এটি তো ছিল তোমার পক্ষ থেকে একটি পরীক্ষা। এর মাধ্যমে তুমি যাকে চাও পথভ্রষ্ট করো আবার যাকে চাও হেদায়াত দান করো। তুমিই তো আমাদের অভিভাবক। কাজেই আমাদের মাফ করে দাও এবং আমাদের প্রতি অনুগ্রহ করো। ক্ষমাশীলদের মধ্যে তুমিই শ্রেষ্ঠ" (সূরা আরাফ : ১৫৫ দ্রষ্টব্য)

★ পৃথিবীর চুড়ান্ত ভূমিকম্পের মধ্যে দিয়েই কিয়ামত সংঘটিত হবে। সেদিন সকল টেকটোনিক প্লেট একযোগে শুধুমাত্র একটি নির্দেশই পালন করবে, মহান রবের নির্দেশ। কুরআনের ভাষায়-

اِذَا زُلْزِلَتِ الْاَرْضُ زِلْزَالَهَا- وَ اَخْرَجَتِ الْاَرْضُ اَثْقَالَهَاۙ-

যখন পৃথিবীকে প্রবলবেগে ঝাঁকুনি দেয়া হবে। পৃথিবী তার ভেতরের সমস্ত ভার বাইরে বের করে দেবে। (সূরা যিলযাল-আয়াত ১ ও ২)

لِمَنِ الْمُلْكُ الْیَوْمَ١ؕ لِلّٰهِ الْوَاحِدِ الْقَهَّارِ

(সেদিন ঘোষণা দিয়ে জিজ্ঞেস করা হবে) আজ রাজত্ব কার? (সমস্ত সৃষ্টি বলে উঠবে) একমাত্র আল্লাহর যিনি কাহ্‌হার। (সূরা আল-মু’মিন-আয়াত ১৬)

সকল অবস্থায় মহান রবের করুণাই একমাত্র পাথেয় ।

মন্তব্য